করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে বিশ্বজুড়ে জীবনযাত্রা অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি ও ব্যবহার্য সামগ্রীর মতো ব্যবহৃত গাড়িটিও কীভাবে জীবাণুমুক্ত রাখা যায়, সেটিও ভাবছেন অনেকে।
গাড়ির ভেতরে দৃশ্যমান ময়লা, ধুলো-বালি, আবর্জনা, দুর্গন্ধ না থাকলেই আমরা গাড়ির পরিচ্ছন্নতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি।
কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আমাদের গাড়ি থেকে অদৃশ্য জীবাণু দূর করার শিক্ষাও দিয়েছে।
গাড়ির ভেতরে যেসব অংশে বেশি বেশি হাত দিতে হয় এবং যাত্রীর সংস্পর্শে আসে, সেসব অংশেই জীবাণু ছড়িয়ে থাকতে পারে। দৈনিক বা সাপ্তাহিক বা মাসিক রুটিনে গাড়ি ঝাড়পোছ করার অভ্যাস বাদ দিয়ে, এখন হয়তো অনেকেই প্রতিদিন কয়েক দফায় গাড়ি পরিষ্কার করার কথা ভাবতে শুরু করেছেন।
রাস্তায় চলতে গেলে গাড়ির বাইরের অংশ নানা রকম ধুলো-ময়লা ও জীবাণুর সংস্পর্শে আসবেই। তবে যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য গাড়ির ভেতরের অংশ জীবাণুমুক্ত রাখাটাই বেশি এ মুহূর্তে বেশি জরুরি। বিশেষ করে গাড়িতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে যদি বহন করতে হয়, তাহলে অবশ্যই পুরো গাড়ি ভালোমতো জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে, যাতে নতুন করে কাউকে সংক্রমিত না করে।
ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস, সিনথেটিক লেদার, ফেব্রিক, প্লাস্টিক, রাবার বা উড ফিটিংসের কোনো ক্ষতি না করে গাড়ির ইন্টেরিয়র কীভাবে জীবাণুমুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে কিছু খোঁজখবর করা যাক।
কী কী জীবাণুমুক্ত করা দরকার
গাড়িতে ওঠার পর ইন্টেরিয়রের যেসব অংশে স্পর্শ করতেই হয়, তার সবগুলোই কিন্তু জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ে। কাজেই প্রত্যেকটি অংশ ধরে ধরে পরিষ্কার করতে হবে। যেমন :
- চাবি ও চাবি-রিং
- স্টার্ট বাটন অথবা কি হোল
- ড্যাশবোর্ড সারফেস
- ড্যাশবোর্ড সুইচ
- ইনস্ট্রুমেন্ট প্যানেল
- স্টিয়ারিং হুইল
- ইন্ডিকেটর ও ওয়াইপার নব
- রেডিও বা ডিভিডি সেট
- টাচ স্ক্রিন
- এসির ভেন্ট
- লুকিং মিরর
- সান ভিজর
- কনসোল বক্স/আর্মরেস্ট
- ৱ কাপ হোল্ডার
- গিয়ার শিফট লিভার
- পার্কিং ব্রেক লিভার
- উইন্ডো সুইচ
- উইন্ডো গ্লাস
- ডোর নব
- ডোর হ্যান্ডেল
- ডোর প্যানেল
- হেডরেস্ট
- সিট বেল্ট
- সিট বেল্ট লক
- সিট কভার
- ফ্লোর ম্যাট
সবগুলো যন্ত্রাংশের মধ্যে স্টিয়ারিং হুইলের দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে। কারণ গাড়ির এই অংশটিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে হাতের স্পর্শে থাকে। আমাদের চোখে আণুবীক্ষণিক শক্তি থাকলে, আমরা দেখতে পেতাম, সেখানে সব সময় ভয়ংকর সব ভাইরাস গিজগিজ করছে।
প্রথমে ভ্যাকুয়াম ক্লিনিং
গাড়ি জীবাণুমক্ত করার আগে গাড়িতে জমে থাকা ধুলো-ময়লা ও দৃশ্যমান আবর্জনা আগে পরিষ্কার করতে হবে। হাইপ্রেশার এয়ারগান ব্যবহারের সুযোগ থাকলে, সেটি দিয়ে আলগা ধুলো সরিয়ে নিতে হবে। এরপর ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে পুরো ইন্টেরিয়রের প্রতিটি কোনা পরিষ্কার করতে হবে। বাড়িতে বা হাতের কাছে এসব উপকরণ ও যন্ত্রপাতি না থাকলে, ভালো মানের রিপেয়ার ও সার্ভিস ওয়ার্কশপে (উদাহরণ : কার কারিগর!) গিয়ে নিয়মিত ভ্যাকুয়াম ক্লিন করিয়ে নেওয়া যায়।
আজকাল অনেক ওয়ার্কশপ কার ইন্টেরিয়র স্টিম ক্লিনিং সেবা দিচ্ছে। এটি ইন্টেরিয়র পরিষ্কার করার নতুন প্রযুক্তি বটে, বেশিরভাগ জীবাণু ধ্বংসের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। তবে করোনাভাইরাসের বেলায় কতখানি কাজ করে, তা এখনও জানা যায়নি।
সঠিক জীবাণুনাশক
ইন্টেরিয়র জীবাণুমুক্ত করার সুনির্দিষ্ট পণ্য এখনও বাজারে সহজলভ্য নয়। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের লকডাউন পরিস্থিতি শেষ হলেই বাজারে নানা ব্র্যান্ডের পণ্যে সয়লাব হয়ে যাওয়ার কথা।
ব্যক্তিগত ও ঘরোয়া সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করার উপযোগী ৬০%-৭০% আইসোপ্রপিল অ্যালকোহলযুক্ত যেসব ডিসইনফেকট্যান্ট স্প্রে বা তরল ওয়াইপ এ মুহূর্তে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো গাড়ির ইন্টেরিয়রের উন্মুক্ত হার্ড সারফেসে কার্যকর হতে পারে, যেমন- স্টিয়ারিং হুইল, ড্যাশবোর্ড, আর্মরেস্ট, কনসোল, সিট অ্যাডজাস্টর, গিয়ার নব, ডোর হ্যান্ডেল, ভেন্টিলেশন গ্রিল, রিয়ারভিউ মিরর ইত্যাদি। পরিষ্কার গামছা বা মাইক্রোফাইবার টাওয়ালে অ্যালকোহলযুক্ত তরলটি ভিজিয়ে বা স্প্রে করে নিয়ে ইন্টেরিয়র সারফেস ভালোমতো মুছে নিলে বেশিরভাগ জীবাণু মরে যাওয়ার কথা।
তবে টাচ স্ক্রিন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও লেদার অংশের ক্ষেত্রে অ্যালকোহলযুক্ত লিকুইড ব্যবহারে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি আছে।
সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী সমাধান হাতের কাছেই আছে : সাবান ও পানি!
গামছা বা মাইক্রোফাইবার টাওয়ার ভালো করে ভিজিয়ে নিয়ে সেটি দিয়ে মুছে নিলেই শতভাগ না হলেও, ৯৭-৯৮ শতাংশ জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা করোনাভাইরাসও সাবান-পানিতে ধ্বংস হয়। সাধারণ সাবান গাড়ির ইন্টেরিয়রের জন্যও ক্ষতিকর নয়। শুধু খেয়াল রাখতে হবে, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মধ্যে যেন পানি বা তরল ঢুকে না যায়।
বেঠিক জীবাণুনাশক
গৃহস্থালী, বিশেষ করে কিচেন বা টয়লেটে ব্যবহার্য ক্লিনার দিয়ে কখনই গাড়ির ইন্টেরিয়র পরিষ্কার করতে যাবেন না। নিশ্চিত হয়ে নিন, গাড়ির জন্য ব্যবহৃত ক্লিনিং উপকরণে ব্লিচ ও অ্যামোনিয়া জাতীয় উপাদান নেই। এগুলো থাকলে কিন্তু সর্বনাশ করে দেবে ইন্টেরিয়রের… বিশেষ করে সিনথেটিক লেদার, প্লাস্টিক, ফেব্রিক, উড ও রাবার উপকরণের। ব্লিচ বা অ্যামোনিয়া বা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা অ্যালকোহল জীবাণুর বিরুদ্ধে অতি শক্তিশালী উপাদান, কিন্তু এগুলো গাড়ির ইলেকট্রনিকস ডিভাইস ও টাচ স্ক্রিনের সুরক্ষা আবরণ নষ্ট করে ফেলে। সাধারণত গ্লাস ক্লিনারে (নীল রঙের) অ্যামোনিয়া থাকে, এটি উইন্ডশিল্ডে হয়তো ব্যবহার করা যায়, কিন্তু ইন্টেরিয়রে কোনোভাবেই নয়।
তাৎক্ষণিক জীবাণুনাশক হিসেবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার খুবই কার্যকর, কিন্তু ঘনঘন বা অতি মাত্রায় প্রয়োগে গাড়িতে ব্যবহৃত লেদার বা সিনথেটিক লেদারের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
গাড়ির এক্সটেরিয়র পরিষ্কার
বাজারে গাড়ির ধোয়ার অনেক রকম ক্লিনার পাওয়া যায়। এগুলো যথেষ্ট কার্যকরও বটে। তবে এসব পণ্য কিছুটা দামি হওয়ায়, পেশাদার ড্রাইভাররা শ্যাম্পু মেশানো পানি দিয়ে গাড়ি ধোয়ার কাজ সেরে ফেলে। এসব শ্যাম্পু হালকা মাত্রার হলে, ঠিক আছে। কিন্তু কোনোভাবেই ডিশওয়াশার বা কড়া ডিটারজেন্ট দিয়ে গাড়ি ধোয়া ঠিক নয়। এগুলো গাড়ির পেইন্টের সুরক্ষা আবরণ নষ্ট করে ফেলে। যদি উপযুক্ত কার ওয়াশ উপকরণ হাতের কাছে না থাকে, তাহলে শুধু পানি দিয়েই গাড়ি ধুয়ে ফেলা যেতে পারে।
নিজের সুরক্ষা
- গাড়ির ভেতরে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানোর সময় অবশ্যই মাস্ক পরে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। হাতে গ্লাভস এবং চোখে গগলস জাতীয় কিছু পরে নিন।
- ডিসইনফেকট্যান্ট স্প্রে বা তরলের বাষ্প শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে নিজের ফুসফুসে টেনে নেওয়া বিপজ্জনক। কাজেই গাড়ির সবগুলো দরজা খোলা রাখুন, যাতে বাষ্পটি হালকা হয়ে ছড়িয়ে যায়।
- কাজ শেষে ভালো মতো হাত ও শরীরের উন্মুক্ত অংশ ধুয়ে ফেলুন।
- জীবাণুনাশক স্প্রে বা তরল পদার্থ দাহ্য হতে পারে। কাজেই এসব ব্যবহারের সময় ধুমপান একদম বন্ধ। কাছাকাছি জ্বলন্ত কিছুও যেন না থাকে।
- জীবাণুনাশক উপকরণ নিয়ে সন্দেহ থাকলে প্রথমে ইন্টেরিয়রের এমন অংশে প্রয়োগ করুন, যেটি সহজে দেখা যায় না। যদি কোনো ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া না দেখেন, তাহলে গাড়ির অন্য অংশে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন : করোনাভাইরাস-লকডাউন : গাড়িটা যত্নে রেখেছেন তো?
আরও পড়ুন : গাড়ির ভেতর ইঁদুর বাস? করবে কিন্তু সর্বনাশ!
গাড়ি নিয়ে যে কোনো সমস্যায় অভিজ্ঞ মেকানিকের পরামর্শ নিতে কল করতে পারেন এই নম্বরে :
মোহাম্মদ মাসুম : +৮৮০১৮৪৪২৭৪৪০১
ঠিকানা: কার কারিগর, প্লট-২৭৩/২,৫,৬, পশ্চিম মানিকদী, নামাপাড়া, কালসি রোড, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, ঢাকা-১২০৬, বাংলাদেশ