করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে লকডাউন। গাড়ি চলাচল সীমিত। নিত্যদিনের ব্যবহার্য গাড়িটিও হয়তো গ্যারাজে বন্দী হয়ে আছে। দীর্ঘ দিন স্টার্ট না দেওয়ায়, কেউ কেউ জানাচ্ছেন, তাদের গাড়ির ব্যাটারি বসে গিয়েছে। কেউ কেউ হয়তো লকডাউন শেষে গাড়ি বের করতে গিয়ে এই সমস্যায় পড়তে পারেন।
ব্যাটারি পুরনো বা দুর্বল হলে অথবা অন্য কোনো কারণে চার্জ ক্ষয় হয়ে গেলে, গাড়ি স্টার্ট না নেওয়ার সমস্যা হতে পারে। কার ট্র্যাকিং ডিভাইস বা ডেকোরেশন ডিভাইস লাগানো থাকলে, তা গাড়ি বসে থাকলেও সামান্য কিছু চার্জ ক্ষয় করতে থাকে। অনেক সময় ইন্টেরিয়র লাইট জ্বালিয়ে রেখেই গাড়ি পার্ক করে রেখে দিলে চার্জ ফুরিয়ে যেতে পারে। নিয়মিত প্রতিদিন স্টার্ট দেওয়া হলে, চার্জের সেই ঘাটতিটুকু পুষিয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ বিরতি পড়লে, চার্জ যতখানি কমে যায়, সেই ঘাটতি নিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার মতো ক্ষমতা ব্যাটারির থাকে না।
গাড়ির ব্যাটারি ২/৩ মাস পরপরই পরীক্ষা করানো উচিত। কারণ যখন-তখন সেটি বিগড়ে গিয়ে বিপদে ফেলতে পারে। সত্যি সত্যি যখন বিগড়ে যাবে এবং গাড়ি স্টার্ট নিতে চাইবে না, তখন তো মহাবিপদ। অন্তত ওয়ার্কশপ বা ব্যাটারির ডিলারে কাছে পর্যন্ত নিতে হলেও তো গাড়ি স্টার্ট করাতে হবে।
এ ক্ষেত্রে জাম্পার কেবল ব্যবহার করে জাম্প স্টার্ট করার ব্যবস্থা রয়েছে। সহজ এই উপায়টি ভালো করে শিখে রাখুন। একদিন না একদিন অবশ্যই উপকারে দেবে। আপনি হয়তো নিজেই গাড়ির মালিক, কাজটা নিজে নিজে হয়তো করবেন না, করবে আপনার ড্রাইভার। কিন্তু সে যখন কাজটা করতে শুরু করবে, তখন যেন কোনো অনর্থ না ঘটায়, প্রাথমিক ধারণাটুকু থাকলে আপনিও হয়তো সাহায্যে আসতে পারবেন। তবে দ্বিধা থাকলে বা সাহসে না কুলালে, মেকানিক ডাকাই উত্তম।
এখানে আমরা মূলত ১২ ভোল্টের ব্যাটারিযুক্ত হালকা যানবাহন যেমন- সেডান কার, এসউইভি (জিপ), ভ্যান (মাইক্রোবাস) নিয়ে আলাপ করছি।
কী কী প্রয়োজন?
১. জাম্পার কেবল
বিশ্বের অনেক দেশেই গাড়ি ব্যবহারকারীরা গাড়ির পেছনের ট্র্যাঙ্ক কম্পার্টমেন্টে জাম্পার কেবল রেখে দেন, কখন কী কাজে লাগে। আমাদের দেশে এ অভ্যাস সেই অর্থে নেই। তারপরও গাড়ির ব্যাটারি ডা্ন হয়ে গিয়ে থাকলে, আশেপাশের গাড়ির মালিক বা ড্রাইভারের কাছে খোঁজ করুন। কারও না কারও কাছে জাম্পার কেবল পেয়েও যেতে পারেন। বিশেষ করে রেন্ট-আ-কার বা উবার বা ভাড়ায় চালিত গাড়িতে ড্রাইভাররা এই জিনিস রাখেন। সময়-সুযোগমতো আপনিও কিনে রেখে দিতে পারেন নিজের গাড়ির পেছনে এক কোনায়।
২. পাওয়ার সোর্স (ফুল চার্জড ব্যাটারি-সহ গাড়ি)
যে গাড়ি সহজেই স্টার্ট নিচ্ছে, সেটিই সচল গাড়ি। আপনার সাময়িক অচল গাড়িটি সচল করতে আপাতত ওই সচল গাড়িটির ব্যাটারির ভোল্টেজের সাহায্য সবচেয়ে বেশি দরকার। হাইব্রিড বা ইলেকট্রিক গাড়ির ব্যাটারির সাহায্য নিতে চাইলে, দুর্ঘটনা বা ক্ষতি এড়াতে বাড়তি কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, কাজেই সেই ঝামেলায় না গিয়ে পেট্রোল বা সিএনজি-চালিত গাড়ি বেছে নিন। তবে শুধু গাড়ি পেলেই হবে না, গাড়ির মালিক বা চালককেও সহৃদয় এবং জাম্প স্টার্ট সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
কীভাবে স্টার্ট করবেন?
সহজ কয়েকটি ধাপ ভালোমতো মনের মধ্যে গেঁথে রাখুন। খুব বেশি অসতর্ক না হলে ভুলভাল হবে না আশা করি। তবে বিপদ বা দুর্ঘটনা এড়াতে এই ধাপগুলো ভালোমতো জেনে রাখা এবং সতর্ক থাকা জরুরি।
ধাপ-১. কাছাকাছি পার্ক করুন
অচল গাড়িটি হয়তো নড়ানো যাচ্ছে না, কাজেই সচল গাড়িটিকেই যতখানি সম্ভব কাছাকাছি নিয়ে আসুন। মাঝথানে ১/২ ইঞ্চি ফাঁকা থাকলেই চলবে। তবে অবশ্যই গাড়িদুটো যেন পরস্পরকে স্পর্শ করে না ফেলে। দুটো গাড়িরই ইঞ্জিন, লাইট, রেডিও-সহ সব কিছু বন্ধ রাখুন। গিয়ার লিভার পার্কিং বা নিউট্রাল পজিশনে রেখে পার্কিং ব্রেক প্রয়োগ করুন। আশেপাশে কোনো অগ্নিস্ফূলিঙ্গ যেন না থাকে। কেউ যেন ধূমপানও না করে।
ধাপ-২. প্রস্তুতি
দুটো গাড়ির সামনের হুড খুলুন। ব্যাটারির অবস্থান দেখে নিন। প্রচলিত বেশির ভাগ গাড়িতে ব্যাটারি সামনে হুডের নিচে থাকে (তবে টয়োটা অ্যাকুয়া হাইব্রিড-সহ কিছু কিছু মডেলে ব্যাটারি গাড়ির পেছনের সিটের নিচে বা অন্য কোথাও থাকতে পারে)। দুটো গাড়ির পজিশন এমনভাবে রাখতে হবে, যেন ব্যাটারিদুটো যথাসম্ভব কাছাকাছি থাকে। দুটো গাড়ির ভোল্ট কিন্তু একদম হুবহু একই হতে হবে (১২ ভোল্ট), অ্যাম্পিয়ার আলাদা হলেও অসুবিধা নেই।
ধাপ-৩. জাম্পার কেবল সংযোগ
জাম্পার কেবল জোড়া সাধারণত ৬ ফুট থেকে ২০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। একটি জোড়ায় দুটো অংশ। পজিটিভ অংশটি লাল বা হলুদ বা কমলা রঙের এবং (+) চিহ্নিত। নেগেটিভ অংশটি কালো বা নীল বা ধূসর রঙের এবং (–) চিহ্নিত। তারপরও সন্দেহ থাকলে জাম্পার কেবলের গায়ে খোদাই করা মার্কিং দেখে নিন। গাড়ির ব্যাটারিতে নেগেটিভ ও পজিটিভি দুটো নব থাকে, যেটিকে বলা হয় টার্মিনাল। দেখে নিন টার্মিনালগুলো পরিষ্কার আছে কিনা। অপরিচ্ছন্ন বা ময়লা থাকলে গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া যেতে পারে। নইলে ঠিকমতো কানেকশন পাবে না।
সব কিছু ঠিক থাকলে এরপর সতর্কতার সঙ্গে পরবর্তী ধাপগুলো অনুসরণ করুন :
১. অচল ব্যাটারিতে লাল : পজিটিভ কেবলের এক প্রান্তের ক্লাম্প প্রথমে অচল (ডেড) ব্যাটারির পজিটিভ (+) টার্মিনালে স্থাপন করুন।
২. সচল ব্যাটারিতে লাল : পজিটিভ কেবলের অন্য প্রান্তের ক্লাম্প সচল ব্যাটারির পজিটিভ (+) টার্মিনালে সংযুক্ত করুন।
৩. অচল ব্যাটারিতে কালো : নেগেটিভ কেবলের এক প্রান্তের ক্লাম্প প্রথমে সচল ব্যাটারির নেগেটিভ (–) টার্মিনালে স্থাপন করুন।
৪. অচল গাড়ির ধাতবে কালো : নেগেটিভ কেবলের অন্য প্রান্তের ক্লাম্পটি অচল গাড়ির ইঞ্জিনের রঙবিহীন উন্মুক্ত ধাতব অংশে (বোল্ট-হেড বা ব্র্যাকেট) আটকে দিন।
কোনটার পর কোন কেবল সংযুক্ত করবেন, এটি ভালোমতো বুঝে নিন। নেগেটিভ-পজিটিভ গড়বড় হয়ে গেলে বা লুজ কানেকশন হলে কিংবা পজিটিভ আর নেগেটিভ সংযোগ পরস্পরের সংস্পর্শে এলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুটো গাড়ির স্থায়ী ক্ষতিও হতে পারে। জাম্পার কেবল যেন ফ্যানবেল্ট বা ইঞ্জিনের সচল পার্ট বা ফুয়েল সিস্টেম থেকে যথেষ্ট দূরে থাকে, সেটি খেয়াল রাখুন। অচল ব্যাটারির নেগেটিভ টার্মিনালে কখনই জাম্প কেবলের ক্লাম্প লাগাবেন না, এটি একটি কমন ভুল, এর কারণে ব্যাটারি স্পার্ক বা বিস্ফোরণের বিপদ ঘটতে পারে।
ধাপ-৪. স্টার্ট দিন
প্রথম সচল গাড়িটি স্টার্ট দিন। ১৫ সেকেন্ড পরে স্টার্ট দিন অচল গাড়িটি। অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে, অচল গাড়িটি তৎক্ষণাৎ স্টার্ট নিয়ে নেবে। (যদি স্টার্ট নিতে না চায়, তাহলে নেগেটিভ-পজিটিভ সংযোগগুলো ঠিকঠাক লেগেছে কিনা, পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিন। তারপরও যদি না হয়, তাহলে হয়তো ব্যাটারি নয়, অন্য কোনো সমস্যা। অথবা অচল ব্যাটারিটি সম্ভবত সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। হয় এখুনি ব্যাটারি বদলাতে হবে, নয়তো ওয়ার্কশপে নিতে হবে। অনেক সময় ফিউজ, অলটারনেটর, সেলফ স্টার্টার বা ওয়্যারিং সিস্টেমে সমস্যা থাকলেও স্টার্ট নিতে সমস্যা করতে পারে। )
ধাপ-৫. সংযোগ বিচ্ছিন্ন করুন
অচল গাড়িটি স্টার্ট নেওয়ার পর কিছু সময় স্টার্টেই রাখতে হবে। কিন্তু স্টার্ট নেওয়া হয়ে গেলে জাম্পার কেবলের আর কাজ নেই। এবার সংযোগটি খুলে নেওয়া যাবে। যে ক্রম অনুযায়ী কেবল সংযুক্ত করা হয়েছিল, খুলতে হবে তার বিপরীত ক্রম অনুযায়ী, অর্থাৎ ৪, ৩, ২, ১… এভাবে। সিরিয়াল গড়বড় করলেও কিন্তু বিপদ ঘটার সম্ভাবনা।
ধাপ-৬. অন্তত ১৫ মিনিট স্টার্টে রাখুন
সদ্য স্টার্ট নেওয়া ইঞ্জিন অন্তত ১৫ মিনিট চালিয়ে রাখতে হবে অচল ব্যাটারি পুরোপুরি চার্জ হওয়ার জন্য। পার্ক করা অবস্থায় রেখেও দিতে পারেন, আবার কিছুক্ষণ চালানোও যেতে পারে। অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে, গাড়ি এখনই বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় নেই। একবার চার্জ হয়ে গেলে আপাতত কিছু সময়ের জন্য কিংবা স্টার্ট থাকা পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকা যেতে পারে বটে, কিন্তু অবিলম্বে ব্যাটারির ডিলার বা অভিজ্ঞ মেকানিককে দিয়ে ব্যাটারির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি। এমনও হতে পারে, জাম্প স্টার্ট দিয়ে চালু করার পর যেই বন্ধ করলেন, তারপর হয়তো আর স্টার্ট নিলই না। তখন আবার জাম্প স্টার্ট দিয়ে চালু করতে হবে। তবে জেনে রাখবেন, আপনার ব্যাটারির আয়ু শেষ। এই যে গাড়ি স্টার্ট করলেন, এটা থাকা অবস্থাতেই দোকানে গিয়ে দ্রুত নতুন ব্যাটারি কিনে নিতে হবে।
আজকাল অনলাইন ইকমার্স পোর্টাল ও ঢাকার বিভিন্ন অ্যাক্সেসরিজের দোকানে পোর্টেবল ব্যাটারি প্যাকও পাওয়া যায়। দাম ২,০০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকার মতো। এটি সরাসরি গাড়ির ব্যাটারিতে সংযুক্ত করে সহজেই জাম্প স্টার্ট করা সম্ভব। সুযোগ হলে এই জিনিসও কিনে গাড়ির পেছনের কমপার্টমেন্টে রেখে দিতে পারেন। নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগবে, আশেপাশে অন্যকে বিপদে পড়তে দেখলেও সাহায্য করতে পারবেন।
আরও পড়ুন : করোনাভাইরাস-লকডাউন : গাড়িটা যত্নে রেখেছেন তো?
গাড়ি নিয়ে যে কোনো সমস্যায় অভিজ্ঞ মেকানিকের পরামর্শ নিতে কল করতে পারেন এই নম্বরে :
মোহাম্মদ মাসুম : +৮৮০১৮৪৪২৭৪৪০১
ঠিকানা: কার কারিগর, প্লট-২৭৩/২,৫,৬, পশ্চিম মানিকদী, নামাপাড়া, কালসি রোড, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, ঢাকা-১২০৬, বাংলাদেশ